মুজিব হত্যায় ভূমিকা রেখেছিল যে পীর
আন্ধা হাফিজ: চট্টগ্রামের হালিশহরের রহস্যময় পীর এবং তার ভবিষ্যদ্বাণীর গল্প
মুজিব হত্যায় ভূমিকা রেখেছিল যে পীর
বিংশ শতকের সত্তরের দশকের দিকে চট্টগ্রামের হালিশহরে একজন পীরের উত্থান হয়, যিনি 'আন্ধা হাফিজ' নামে পরিচিত ছিলেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, তিনি একজন কামেল পীর ছিলেন। তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো প্রায়শই বাস্তবে রূপ নিত, যা তাকে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বিখ্যাত করে তোলে।
তবে, আন্ধা হাফিজ সবচেয়ে আলোচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের সাথে পরোক্ষভাবে সংযুক্ত থাকার অভিযোগে। এই বিষয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার "Bangladesh: A Legacy of Blood" বইয়ে কিছু দাবি করেছেন। এছাড়াও, হুমায়ূন আহমেদের 'দেয়াল' উপন্যাসে আন্ধা হাফিজের চরিত্র কিছুটা উল্লেখিত হয়েছে।
জীবনী ও জীবনবৃত্তান্ত
আন্ধা হাফিজ নিজস্ব ভাষ্যমতে, তার জন্ম ভারতের লখনৌতে। তার পৈতৃক বাড়ি সেখানেই ছিল। তিনি ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রামের হালিশহরে বসবাস শুরু করেন এবং পীর হিসেবে তার পথচলা শুরু করেন। তার বড় ভাই চট্টগ্রাম রেলওয়েতে চাকরি করতেন।
তার অনুসারীদের মতে, আন্ধা হাফিজের অসংখ্য মুরিদ ছিল, যারা তার প্রতি অগাধ আস্থা রাখত।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বই অনুসারে, মেজর ফারুক আন্ধা হাফিজের পরামর্শ নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
১৯৭৫ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে মেজর ফারুক চট্টগ্রামের হালিশহরে এসে আন্ধা হাফিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জনশ্রুতি মতে, ফারুকের হাতে হাত রেখে আন্ধা হাফিজ দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বলেন:
“আমি জানি তুমি ভয়ঙ্কর কিছু করতে যাচ্ছ। করতে চাও কর, তবে মনে রেখো, আমি তোমাকে যে নীতি অনুসরণ করতে বলছি, তা যদি তুমি পালন না কর, তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।”
তিনি মেজর ফারুককে তিনটি নীতি মেনে চলার পরামর্শ দেন:
১. আল্লাহ এবং ইসলামের জন্য ছাড়া ব্যক্তিগত লাভের জন্য কিছু করবে না।
২. শক্তি অর্জন কর।
৩. সঠিক সময় বেছে নাও।
শেখ মুজিব হত্যা পরিকল্পনার খবর আন্ধা হাফিজের কাছে পৌঁছানোর জন্য মেজর ফারুক তার স্ত্রী ফরিদাকে পাঠান। ফরিদার কাছে হাফিজ বলেন:
“তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তোমাদের যা করার, করে ফেলো। তবে অত্যন্ত গোপনে কাজটা করতে হবে।”
বিতর্ক এবং অস্বীকৃতি
আন্ধা হাফিজ পরে এক সাক্ষাৎকারে অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের দাবি অস্বীকার করেন। তার বক্তব্যে তিনি বলেন:
“অ্যান্থনি মাসকারেনহাস কখনও আমার কাছে আসেননি। তার সমস্ত দাবি বানোয়াট। আমি কারও ক্ষতি করার জন্য দোয়া করতে পারি না।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, শেখ মুজিব হত্যার পর ফারুক-রশীদ তার কাছে আর আসেননি।
অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণী
আন্ধা হাফিজ জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের উত্থান সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সেই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোও সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়েছিল।
বিতর্কিত সম্পর্ক
সাপ্তাহিক বিচিন্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আন্ধা হাফিজের বক্তব্য প্রকাশিত হলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে চট্টগ্রামের সব পত্রিকা কিনে নেন, যাতে সেগুলো আর কেউ না পড়তে পারে। পরে এই পত্রিকার পুনর্মুদ্রণ হলে তা জনসাধারণের হাতে পৌঁছে যায়।
আন্ধা হাফিজ পত্রিকার সম্পাদক মিনার মাহমুদকে ফোনে বলেন:
“তোর মতো সাংবাদিক আমি এক নিমেষেই গায়েব করে ফেলতে পারি।”
উপসংহার
আন্ধা হাফিজের জীবন এবং কার্যকলাপ নিয়ে বিতর্ক ও রহস্য এখনো রয়ে গেছে। তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো একদিকে তার মুরিদদের জন্য প্রেরণার উৎস হলেও তার ইতিহাসকে গোপন করা হয়েছে।
No comments